সকাল সাড়ে আটটা। হলুদ রোদ মাখা শ্যামবাজার মোড় থেকে ট্রামগাড়ি বাঁক নিচ্ছে ছায়াঝরা বিধান সরনীর দিকে। কর্চরিকার দেখা পেতে হলে, এটাই সেরা সময়। কর্চরিকা আদি নাম। আর এখন, কচুরি। যার গল্প শুরু করতে হলে, উত্তরের কলকাতায় পা রাখতেই হবে। WhatsApp-এ পাওয়া একটি রচনার উপরে আধারিত এই লেখার কারণ আমি নিজেও কর্চরিকা ভক্ত।
শ্যামবাজার মোড়েই পাশাপাশি দুই হরিদাস মোদকের দোকান। তার মধ্যে যে দোকানটা একটু পুরনো দেখতে, সেখানে একবার ঢুকে পড়লেই, কেমন যেন চুপচাপ হয়ে যায় চারপাশ। কাঠের বেঞ্চ-টেবিল। রঙ-চটা দেয়ালে মহাপুরুষদের বাঁধান ছবি, রজনীগন্ধার সরু মালা ঝুলছে সেখানে। কলকাতার আকাশ যখন আরো একটু নীল ছিল, ধুতি পরা যুবকের দিকে যখন কেউ অবাক হয়ে ঘুরে তাকাত না, যেন সেই হাওয়াবাতাস আজো থমকে আছে এখানে। আর, আধোআবছায়া থেকে ঝুড়ি হাতে একজন এগিয়ে আসছে আপনার দিকে। সবুজ কলাপাতায় ঘিয়েরঙা দুটি কচুরি থিতু হল তারপর। তার সঙ্গে হাতা ভরা ছোলার ডাল। নাহলে খোসা সমেত আলুর তরকারি। রসিক মাত্রেই জানেন, শ্রীরাধিকা যেমন বৃন্দাবনচন্দ্রের আহ্লাদিনীশক্তি, কচুরির সঙ্গে ডাল বা তরকারির সম্পর্কও ঠিক তাই। আমরা যুগল বড় ভালবাসি। সে যাই হোক, এই দোকানে কচুরি মিলবে শুধু সকালে। … তারপর লুচি ।
অভিধান বলছে, ডালের পুর দেয়া ভাজা খাবারই হল ‘কচুরি’। সেভাবে দেখলে, ছোলার ডালের পুরীকেও কচুরি বলতে হবে। কিন্তু না। খাঁটি কচুরিতে কাঁচা বিউলির ডাল আর হিঙের পুর ছাড়া অন্য কিছু চলবে না। আবার ঐ একই পুর যখন পাঁচফোড়ন দিয়ে ভাজা হয়ে ময়দার লেচিতে ভরা হবে, তখন তার নাম ‘রাধাবল্লভী’। শীতের কথা আলাদা। তখন কড়াইশুঁটির পালা।
এসব কথার ফাঁকে, পাঁচমাথার মোড় ছেড়ে পানসি ভিড়েছে বাগবাজারে, পটলার ঘাটে। চলুন, নেমে পড়া যাক। বাগবাজারে যখনই ঢুকেছি, রাস্তার দু’পাশে সাজানো থরে থরে কচুরি দেখে একটাই কথা মনে হয়েছে, এত কচুরি খায় কারা! উত্তর মেলেনা। শুধু ভোজবাজির মতো খালি হয়ে যায় ঝুড়ির পর ঝুড়ি। কিন্তু, এই ভিড়েও পটলার কচুরির হিসেবনিকেশ আলাদা। সে অটল হিমাদ্রীসম। দেখতে দেখতে তিরানব্বই বছর পার করে দিল এই ছোট্ট দোকান!
কচুরী আর ছোট আলুর তরকারি, শালপাতার বাটিতে ছড়িয়ে পড়ছে হাতে হাতে। বিকেলে এখানে রাধাবল্লভী পাবেন। দুটি বল্লভী, দু’টুকরো আলুর দম। পাকা খদ্দের ভুলেও কোনোদিন একটুকরো আলু বেশি চাইবেনা। চাওয়াটা ভব্যতা নয়। যা দেওয়া হয়েছে, একেবারে ঠিকঠাক। ঐ আলুরদম বাজার খুঁজেও পাওয়া যাবেনা।
এবার সুকিয়া স্ট্রিট। মোড় থেকে কয়েক পা এগোলেই গীতিকা। সরু একফালি দোকানে, কাঠের পাটাতনে বসে একটানা কচুরি বেলে চলেছেন একজন। পাশেই ময়দার তাল ঠাসা চলছে। এখানে কচুরি পাওয়া যায় যেকোন সময়। হিঙের কচুরি। আলুর তরকারি আর চাটনি মাখিয়ে মুখে দিলে কী হবে, বলি কেমনে!
পরের দিন সোজা কলেজ স্ট্রিট। পুঁটিরামের দোকানে। দশটার পর এখানে রাধাবল্লভীর পালা। সঙ্গে কাঁচা সোনার ছোঁয়া লাগা ছোলার ডাল। হালকা একটু আদা ফোঁড়নের গন্ধ, মন ছুঁয়ে যাবে বারবার। কলকাতায় কচুরির খোঁজ সাঙ্গ করা, আর পিছনদিক করে এভারেস্টে ওঠা, দুটোই একরকম। তবু এই ঝাঁকি দর্শনে একটু অন্যরকম স্বাদের কথা বলতে ইচ্ছে করছে এবার।
ধর্মতলায়, কর্পোরেশন আর চাঁদনির ক্রসিঙে থমকে দাঁড়িয়েছি বারবার। পাশাপাশি দুটো অবাঙালি কচুরির দোকান। যেকোনো একটায় ঢুকে পড়লেই হল। তবে এখানে কচুরির থেকেও টানটা বেশি কাঁচা লঙ্কার আচারের আচারের দরুন। ঘন সবুজ এই আচারের মোহে পড়েছিল কলকাতার নব্বই দশকের কবিরা। তারা এর নাম দিয়েছিল, শয়তানের কচুরি। এখানকার আম-আদার চাটনিটিও মন্দ নয়। হিঙের কচুরি, চাটনি, আচার আর তরকারি। ফুরিয়ে এলেই, বাটি ভরে ঢেলে দিয়ে যাচ্ছে আবার। যাকে বলে ভরপেট খাওয়া।
কচুরির কথায় একটা বিষয় পরিষ্কার করে জানানোর দরকার। কলকাতার নামকরা বহু মিষ্টির দোকানেই কচুরি পাওয়া যায়। আমার- আপনার পাড়ার দোকানেও যায়। নামডাক সব ক্ষেত্রেই অল্পবিস্তর রয়েছে। কিন্তু এখানে আমরা খোঁজ করছি সেইসব দোকানের, যাদের তেলেভাজা বা মিষ্টির চাহিদা থাকলেও, লোকে তাদের চেনে কচুরি দুনিয়ার নক্ষত্র বলে। এরকমই একটা দোকান হল ভবানীপুরের শ্রীহরি। এটাসেটা মিষ্টি আছে হরেকরকম। কিন্তু ভিড়টা হল কচুরি আর রাধাবল্লভীর। শ্রীহরি কখনো ফাঁকা দেখেছি, এরকমটা ঠিক মনে পড়েনা। এখানেও আসল চাহিদাটা বোধহয় ছোলার ডালের।
কিছু বলা হল। আর বাকি থেকে গেল অনেকটাই। শ্যামবাজারের দ্বারিক, দেশপ্রিয় পার্কের কাছে মহারানি, বা খিদিরপুরের বহু পুরনো অবাঙালি কচুরির দোকান। কলকাতার আঁকাবাঁকা গলির আবছায়ায় লুকিয়ে থাকল কতজন। আর তাছাড়া, রুচিভেদ বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। মল্লিকবাজার, রাজাবাজার বা কলাবাগানের মুসলিম বস্তিতে, সকাল-বিকেল রাশি রাশি কচুরি ভাজা হচ্ছে। ওরা যদিও বলে পুরী। সেই গরম কচুরি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা শিককাবাব খেতে কতজনকে দেখেছি। এই দেখুন, আমিষের কথায় এসে, মাছের কচুরির কথাটা মনে পড়ল হঠাৎ। কিশোর সাহিত্যিক হেমেন্দ্র কুমার রায়ের দুই বিখ্যাত নায়ক বিমল আর কুমারকে, চাকর রামহরি মাঝেসাঝেই মাছের কচুরি বানিয়ে খাওয়াত। বাগবাজারের দু’একটা দোকানে এখনো মাছের কচুরির খোঁজ মিলবে। আর মিলতে পারে ধর্মতলার ডেকার্স লেনে। আপনজন-এর দোকানে।আজকাল কলকাতায় ফুচকার মতো ক্লাব কচুরি ও দেদার বিকোচ্ছে। কিন্তু সেতো এই সেদিনের কথা। তারপর? তার আর পর নেই। বেরিয়ে পড়ুন এবার। ঐ বহু দূর হতে কচুরির ডাক, থুড়ি, সুবাস ভেসে আসে। সামলে খাবেন। পরের দিন আবার খেতে হবে তো!
One Comment Add yours